শিক্ষাক্রম কি?

বলা হয়ে থাকে যে, শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। আর এই শিক্ষাই হল একটি দেশ এবং জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। উন্নত জীবনযাপন এবং সমাজের অগ্রগতি আনার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। তবে শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। 

আর এই আর্টিকেলে শিক্ষাক্রম কাকে বলে, শিক্ষাক্রম কি ও শিক্ষাক্রমের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ

শিক্ষাক্রমের ইতিহাস?

রাফ টাইলারকে শিক্ষাক্রমের জনক বলা হয়। শিক্ষাক্রমের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে কারিকুলাম (curriculum)। আর এই Curriculum শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ‘currere’ থেকে। 

ল্যাটিন শব্দ ‘currere’ অর্থ হল ‘পাঠ্যসূচি’ বা (course of study)। আবার অনেকে মনে করেন যে, ল্যাটিন শব্দ ‘currer’ থেকে ইহা এসেছে। যার মূল অর্থ দ্বারায় ‘ঘোড় দৌড়ের মাঠ’।

শিক্ষাক্রম কাকে বলে?

শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনাকে শিক্ষাক্রম বলা হয়। কোন একটি শিক্ষা কার্যক্রম কি উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে এবং কি বিষয়বস্তুর মাধ্যমে উদ্দেশ্য অর্জিত হবে, কখন, কীভাবে, কার সহায়তায় ও কি উপকরণের সাহায্যে তা বাস্তবায়িত হবে, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে এসবের যাবতীয় পরিকল্পনার রূপরেখাকে শিক্ষাক্রম বলা হয়।

শিক্ষাক্রমের ধারণা?

শিক্ষাক্রমের ধারণার উৎপত্তির শুরুতে শিক্ষাক্রম সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হতো। আর সময়ের ব্যবধান ইহা শিক্ষা ও শিক্ষাদান কর্মকাণ্ড পরিচালনার সামগ্রিক পরিকল্পনা হিসেবে লাভ করেছে। তবে শিক্ষাক্রম নিয়ে গবেষণা থেমে নেই কিংবা নির্দিষ্ট কোন গণ্ডীর মধ্যে আটকে নেই। 
শিক্ষাক্রম
শিক্ষাক্রম

শিক্ষাক্রম নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণার ফলে এ সংক্রান্ত আরও নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষা বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবশ্যই শিক্ষাক্রমের ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন।

শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ধারণা?

শিক্ষাক্রম শব্দটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ও যুগের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাক্রমের ধারণা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে। আর তাই শিক্ষাক্রমের সর্বজনস্বীকৃত কোনও একক ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা কিংবা ধারণার উদ্ভব হয়নি। তবে প্রাচীনকালে মানুষের বেঁচে থাকার দক্ষতা অর্জনই ছিল শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। 

যার ফলে তখনকার অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় এ দিকটি খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। তবে পরবর্তীতে ক্রমাগত শিক্ষা সম্পর্কিত মানুষের চিন্তার ফসল হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাক্রমের ধারণা বাস্তব রূপ পেতে থাকে। শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ধারণামতে কোন শ্রেণি বা স্তর বা কোর্সের অন্তর্ভুক্ত বেশ কয়েকটি পাঠ্যবিষয়ের সমষ্টি হলো শিক্ষাক্রম। 

১৮২০ সাল থেকে আমেরিকায় শিক্ষাক্রমের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে কোন একটি কোর্সের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্যবিষয়কে বুঝাত, যা অনুসরণ করে শিক্ষকরা শ্রেণিতে পাঠদান করাতো। সে সময়ে আমেরিকার শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল শিশুর মানসিক ও জ্ঞানের বিকাশ। আর এজন্য শিক্ষাক্রমে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্খলা অর্জনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। 

প্রাচীনপন্থী শিক্ষাবিদদের ধারণা ছিল যে, শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে কতগুলো অপরিহার্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর এগুলো হল মাতৃভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন এবং পশ্চিমা দেশের ভাবধারা। যার কারণে সেই সময় শিক্ষাক্রমে এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতো।

শিক্ষাক্রম আধুনিক ধারণা?

১৯৩০ সালের পর থেকে মোটামুটিভাবে বলা যায়  শিক্ষাক্রমের প্রাচীন এবং সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয়। বেশিরভাগ শিক্ষাবীদ গণ মনে করেন যে, শিক্ষাক্রমের ধারণার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে ১৯৩০ সালের পরে দিকে। 

আর তখন শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সকল ধরনের শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বুঝানো হতো। তবে ১৯৩৫ সালে ক্যাসওয়েল এবং কম্পবেল শিক্ষাক্রমের পুরাতন ধারণার অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন সংজ্ঞার প্রস্তাব করেন, তা হল “(শিক্ষাক্রম হচ্ছে শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সকল অভিজ্ঞতা)”। 

এরপর থেকে শিক্ষাক্রম তার সংকীর্ণ ধারণার গণ্ডি পার হয়ে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে ও শিক্ষাক্রম কেবলমাত্র পাঠ্য বিষয়ের পরিবর্তে স্কুলের নিয়ন্ত্রিত সকল শিখন-অভিজ্ঞতার সমষ্টিরূপে পরিগণিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ রাফ টাইলার কর্তৃক প্রদত্ত ধারণায় শিক্ষাক্রম সম্পর্কিত এ সমস্যার কিছুটা সমাধান পাওয়া যায়। 

রাফ টাইলার সর্বপ্রথম বলেন যে- “শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্কুল কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত এবং শিক্ষার্থীর অর্জিত সকল শিখন অভিজ্ঞতা” রাফ টাইলারের সংজ্ঞায় দেখা যায় যে, রাফ টাইলার শিক্ষাক্রমকে স্কুল পরিচালিত সকল কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যভিত্তিক এবং পরিকল্পিত শিখন অভিজ্ঞতা নির্ভর করার উপর জোর দিয়েছেন। 

তবে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের প্রভাব প্রকটরূপে দেখা যায়। তখন শিক্ষাক্রমের ধারণা পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে আমেরিকায় বেশ কিছু শিক্ষামূলক প্রকল্প (Educational Projects) গ্রহণ করা হয়। 

আমেরিকার শিক্ষামূলক প্রকল্পে যেসব শিক্ষাবিদ কাজ করতেন তারা শিক্ষাক্রমকে পাঠদানের নির্দেশনামূলক পরিকল্পনা (Instructional Plan) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। ৬০ দশকের শেষে এবং সত্তরের দশকের প্রথমে অনেকে স্কুলের কাজকে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন।

শিল্প কারখানায় যেমন কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করে নানারকম দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয়, তেমনিভাবে স্কুলের কাজ হবে নিরক্ষর এবং অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীদের দক্ষ, অভিজ্ঞ ও অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। 

এর ফলে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন এবং স্কুলের জবাবদিহিতার প্রশ্ন গুরুত্ব পেতে থাকে। শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু নির্বাচন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মত করার লক্ষ্যে এ সময় শিক্ষাক্রমে আচরণিক উদ্দেশ্য লেখার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

এ সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বিভিন্ন মনীষী কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষাক্রমের ধারণায় শিক্ষাক্রমের এই পরিবর্তিত ও সুনির্দিষ্ট রূপ গুরুত্ব পেতে থাকে। এভাবে সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষাক্রমের ধারণায় নতুন নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় ও পুরাতন ধারণার পরিবর্তন ঘটতে থাকে।

শিক্ষাক্রমের উপাদান?

বিভিন্ন সংজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করলে শিক্ষাক্রমের মোট ৪টি উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়ঃ
  • উদ্দেশ্য
  • বিষয়বস্তু
  • শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল এবং
  • মূল্যায়ন
শিক্ষাক্রমের এই ৪টি উপাদানের অর্থ হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কোন বিষয়বস্তু পাঠদানের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসমূহ অর্জিত হবে, কোন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তা শিখবে ও শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে। 

আর এ সম্পর্কিত সকল নির্দেশনার সমষ্টিই হচ্ছে শিক্ষাক্রম। এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, নির্ভরশীল ও পরিপূরক হয়। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং উন্নয়নকালে এর প্রত্যেকটি উপাদান সম্পর্কে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়।

পরিশেষে বলা যায় প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাক্রম হল একটি ব্যাপক ধারণা। যার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গড়া এবং  শিক্ষার্থীদেরকে কর্মে নিয়োজিতকরণের একটি সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার মূল দিকনির্দেশনা।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post